ঢাকা, বৃহস্পতিবার ০২, মে ২০২৪ ১৬:১১:৪৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
সবজির বাজারে স্বস্তি নেই যুদ্ধকে ‘না’ বলতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছি ভারী বর্ষণে মহাসড়কে ধস, চীনে ২৪ প্রাণহানি রাজবাড়ীতে ট্রেন লাইনচ্যুত, রেল যোগাযোগ বন্ধ এভারকেয়ারের সিসিইউতে ভর্তি খালেদা জিয়া মহান মে দিবসে মেহনতি মানুষের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা মদিনায় ভারি বৃষ্টিতে বন্যা, রেড অ্যালার্ট জারি

১৫০ বছরের পুরনো রামমোহন লাইব্রেরী ঢাকার প্রথম পাঠাগার

আইরীন নিয়াজী মান্না | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:১১ পিএম, ১১ নভেম্বর ২০২৩ শনিবার

১৫০ বছরের পুরনো রামমোহন লাইব্রেরী আদি ভবন।

১৫০ বছরের পুরনো রামমোহন লাইব্রেরী আদি ভবন।

তখন আমি ঢাকার একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিক পত্রিকায় জৈষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করি। সে প্রায় বছর দশেক আগের কথা বলছি। আমার ওপর দায়িত্ব পরেছে পুরনো ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ড নিয়ে প্রতিবেদন করার। পুরনো ঢাকার প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা আছে। এই এলাকার প্রাচীন স্থাপনা, সরু সরু গলি, এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইতিহাস আমাকে দারুণ টানে। তাই এই দায়িত্ব পেয়ে আমি তো ভীষণ খুশি। এই প্রতিবেদন করতে গিয়ে আমি একটি প্রাচীন স্থাপনার দেখা পাই। এটি নিয়েই আজ আমার গল্প।

ঢাকার প্রথম লাইব্রেরী বা পাঠাগার কোনটি প্রশ্ন করা হলে অনেকেই এর সঠিক উত্তর দিতে পারবে না। আর এই প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কও বহু পুরনো। সেই বিতর্কে চাপা পড়ে যায় আসল প্রাচীন লাইব্রেরির কথায়। অনেকেই হয়তো জানেন না ঢাকার সবচেয়ে পুরনো লাইব্রেরি হলো ‘রামমোহন রায় পাঠাগার’। 

এই পাঠাগারের বয়স ১৫০ বছরের বেশি। পুরান ঢাকার পাটুলিয়াতে কলেজিয়েট স্কুলের পাশেই অবস্থিত এই লাইব্রেরি আজও দাঁড়িয়ে আছে অতীতের মেরুদন্ডের ওপর ভর করে। স্মৃতির ধুলোয় স্তর পরেছে অনেক।  ঝাপসা হয়ে গেছে দৃষ্টি। কিন্তু তারপরও আকর্ষণ কমেনি মোটেও।

ইতিহাস প্রতিনিয়ত গল্প বলে। তেমনই এখানকার ইতিহাস বলছে, ১৮৭১ সালে উদ্যোগ নেওয়া হয় এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার। তার আগে বেদের একেশ্বরবাদের ওপর নির্ভর করে ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্ম সমাজ।  ব্রাহ্ম সমাজে রামমোহনের সঙ্গে আরও ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।  পুরান ঢাকায় ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মকর্ম সংস্কারের পাশাপাশি ১৮৭১ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকার নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ অভয় চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে ‘রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।  ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন রায়ের নামানুসারে এই পাঠাগারের নামকরণ করা হয়।

পাঠাগারের পাশাপাশি ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগ ছিল উপাসনা, ধর্মালোচনা ইত্যাদি সংস্কারমূলক কাজ।  ব্রাহ্মসমাজ ১৯১০ সালে ‘রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার ভবন’ প্রতিষ্ঠা করে।  কিন্তু পাঠাগার ভবনটি জরাজীর্ণ হওয়ায় গত কয়েক বছর তার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তাই পাঠাগারটি সংস্কার করে শিক্ষা ও সাহিত্যের জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে মন্দির ভবনের দ্বিতীয় তলায় তা স্থানান্তর করা হয়েছে। এই ভবনের গায়ে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার সালটি লেখা রয়েছে ১৮৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি।

কত ইতিহাসের সাক্ষী এই পাঠাগার! কত লড়াই আর সংগ্রামের ইতিহাস এর পাতায় পাতায়। নাট্যজন অভয় চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সমৃদ্ধ হতে শুরু করে এই পাঠাগার। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দানে স্বয়ং সরস্বতীর আশীর্বাদ যেন ঝরে পড়ে এই লাইব্রেরির ওপর। ১৯৪৭ সালেও এখানে বইয়ের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার।  আর এখন হাজারের কম!

বর্তমানে উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে বিশ্ববাণী প্রকাশিত (বঙ্গাব্দ ১৩২৪) মহাভারতের ২১ পর্ব, বিশ্বভারতী প্রকাশিত (বঙ্গাব্দ ১৩৫০) রবীন্দ্র রচনাবলী, ব্রাহ্ম ধর্মভিত্তিক প্রায় সব বই, রাজা রামমোহন, স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী। আছে সব ধর্মগ্রন্থ। এ ছাড়া বঙ্কিম, বিভূতি, শরৎ থেকে শুরু করে হু্মায়ূন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বইও কিছু কেনা হয়েছে। তবে পুরোনো বইগুলোর কিছু কিছু বাঁধাই নষ্ট হয়ে পড়ার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

একাত্তরে পাক বাহিনীর হানায় সব ছাড়খার হয়ে গেলো সব। এভাবেই রীতিমত অদৃশ্য হয়ে যায় বাঙালির গর্বের লাইব্রেরিটি। হানাদার বাহিনী এই লাইব্রেরি থেকে গুরুত্বপূর্ণ বই গায়েব করে দেয়। সেই হিসেবে লাইব্রেরিটি একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়।

১৯২৬ সালে এখানে এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এসেছিলেন ঐতিহাসিক এ পাঠাগারটিতে এসেছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। জ্ঞানতাপস ও বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই পাঠাগারে নিয়মিত আসতেন এবং বই নিয়ে সময় কাটাতেন। বিখ্যাতজনদের মধ্যে আরও এসেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু, অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাই, কাজী মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, কবি শামসুর রাহমান। 

জানলে অবাক হতে হয়, ১৯২৪ সালে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ এখানেই লাবণ্য গুপ্তের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এই পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জীবনানন্দের মা কবি কুসুমকুমারী দেবীও। 

শোনা যায়, ১৮৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকার কিছু বিশিষ্ট দর্শনীয় স্থানের কথা উল্লেখ করেন। সেই স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকার এই রামমোহন পাঠাগার।  

বর্তমানে অতীত বুকে ধারণ করে ধুকে ধুকে চলছে এই অতি প্রাচীন পাঠাগার। লাইব্রেরি হিসেবে জায়গা পেয়েছে ব্রাহ্মসমাজ বিল্ডিংয়ের একটি কক্ষ। যে পাঠাগার এক সময় বহু লোকের পদচারনায় মুখরিত থাকতো তাকে আজ গ্রাস করে আছে শূন্যতা…।